মানচিত্র একজন ভূগোলবিনের জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ (Tools)। এর সাহায্যে সমগ্র পৃথিবী বা কোনো অঞ্চল সরল্যে সুস্পষ্ট জ্ঞান লাভ করা যায়। একটি মানচিত্রের মধ্যে আমরা সব পৃথিবীকে অথবা এর কোনো এক অঞ্চলকে দেখাতে পারি। আমরা কোনো একটি কাগজের মধ্যে মানচিত্র এঁকে সেখানে চিহ্ন নিয়ে সেই অঞ্চলের অবস্থা সম্বন্ধে বুঝাতে পারি। একটি মানচিত্র যে কেবল ভূগোলবিদদের প্রয়োজন হয় তা নয়। এটি প্রশ্ন সকল মানুষের বিশেষ করে পর্যটক, প্রশাসক, পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, আবহাওয়াবিদ এমনকি সাধারণ মানুষেরও বিশেষ প্রয়োজনে লাগে। এ অধ্যায়ে মানচিত্র, এর প্রকারভেল, গুরুত্ব, ব্যবহার, স্থানীয় সময় ও প্রমাণ সময় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করব।
নিচের চিত্রটি লক্ষ কর। এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক মানচিত্র। কাগজের এক পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমা, বাংলাদেশের কোন দিকে কোন দেশ, কোন সাগর ইত্যাদি এঁকে দেখানো হয়েছে। এছাড়া দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের সাতটি বিভাগ, কোন বিভাগে কতটি জেলা ও এদের নাম ও সীমানা। একটি মাত্র পৃষ্ঠার মধ্যে সারা বাংলাদেশের প্রশাসনিক সীমানা তুলে ধরা হয়েছে । এভাবে কাগজের এক পৃষ্ঠার মধ্যেই সময় পৃথিবী, বিভিন্ন মহাদেশ, বিভিন্ন দেশ বা কোনো দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা এঁকে দেখানো যায়।
এই মানচিত্র ছাড়াও তোমরা হয়তো তোমাদের স্কুলে দেয়াল মানচিত্র দেখেছ। তোমাদের ভূগোল ও পরিবেশ বইতে বা কোনো মানচিত্রের বইয়ে (এটলাসে) মানচিত্র দেখে থাকবে। মানচিত্র হলো একটি ছবি বা রেখাকন যা ভূপৃষ্ঠের কোনো ছোট বা বৃহৎ অঞ্চলকে উপস্থাপন করে থাকে। মানচিত্র কোনো অঞ্চল বা দেশের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, উদ্ভিদ, মাটি, পানি ও অনেক কিছু সম্পর্কে ধারণা দেয়। এর সাহায্যে আমরা বিভিন্ন মহাদেশ ও মহাসাগরের অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে পারি। মানচিত্রে একটি ছোট কাগজের মধ্যে অতি নিখুঁতভাবে বিভিন্ন বিষয়ের অবস্থা দেখানো যায়। এখন দেখা যাক মানচিত্র কী?
ইংরেজি 'map' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ মানচিত্র। ল্যাটিন শব্দ 'mappa' থেকে 'mup' শব্দটি এসেছে। ল্যাটিন ভাষায় কাপড়ের টুকরাকে 'mappa' বলে। আগেকার দিনে কাপড়ের উপরই map বা মানচিত্র আঁকা হতো। পৃথিবী বা কোনো অঞ্চল বা এর অংশবিশেষকে কোনো সমতল ক্ষেত্রের উপর অরুন করাকে মানচিত্র বলে। মানচিত্র হলো নির্দিষ্ট ফেলে অক্ষরেখা বা দ্রাঘিমারেখাসহ কোনো সমতল ক্ষেত্রের উপর পৃথিবী বা এর অংশবিশেষের অঙ্কিত প্রতিরূপ। এই সমতল ক্ষেত্র হতে পারে এক টুকরা কাপড় বা কাগজ।
মানচিত্রে ফেল নির্দেশের পদ্ধতি (Methods of showing scale) : মানচিত্রে তিনটি পদ্ধতিতে ফেল নির্দেশ করা হয়।
ক) বর্ণনার সাহায্যে
খ) রেখাচিত্রের সাহায্যে
গ )প্রতিভূ অনুপাতের সাহায্যে
(ক) বর্ণনার সাহায্যে (By statement) : আমরা বর্ণনা বা করার মাধ্যমে মানচিত্রের ক্ষেল প্রকাশ করে থাকি। যেমন- ১ ইঞ্চিতে ৪ মাইল ১৬ ইঞ্চিতে ১ মাইল, ১ সেন্টিমিটারে ১ হেক্টোমিটার। এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রথম ১ সংখ্যাটি (তা ইঞ্চি বা সেন্টিমিটার যাই হোক না কেন) মানচিত্রের দূরত্ব এবং দ্বিতীয় সংখ্যাটি (মাইল, গল্প, কিলোমিটার বা হেক্টোমিটার যাই হোক না কেন) ভূমির প্রকৃত দূরত্ব প্রকাশ করছে।
(খ) রেখাচিত্রের সাহায্যে (By graphical scale) : কোনো একটি রেখাকে প্রয়োজনীয় ইঞ্চি ৩ ইঞ্চির ক্ষুদ্র অংশে বা সেন্টিমিটারের ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে প্রতি ভাগের মান লিখে মানচিত্রের ভেল প্রকাশ করা যায়। যেমন- ১ সেন্টিমিটারে ১০ কিলোমিটার বর্ণনাটিকে রেখাচিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হলে প্রথমে সেন্টিমিটার একটি রেখা নিয়ে একে ৫ ভাগ করতে হবে, এর প্রতিটি ভাগ ১০ কিলোমিটার। বাম পাশে ১টি ঘর ছেড়ে নিয়ে যথাক্রমে ০, ১০, ২০, ৩০, ৪০ লিখে এর পাশে কিলোমিটার লিখতে হবে। বাম পাশের ঘরটিকে আবার ১০ ভাগে ভাগ (কারণ ১০ কিলোমিটারের ক্ষুদ্র ভাগ দেখাতে হবে) করে প্রতিটি ক্ষুদ্র ভাগের মান লিখতে হবে । যেমন-
ইঞ্চি ভেলের ক্ষেত্রে একই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে (চিত্র ৩.২ খ)। এক্ষেত্রে ৩ ইঞ্চি দীর্ঘ একটি রেখা নিয়ে একে প্রথমে তিন ভাগ করতে হবে এবং বাম দিকের একটি ঘর ছেড়ে নিয়ে প্রতি ঘরের মান লিখতে হবে। বাম পাশের ঘরটিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করতে হবে। ১ ইঞ্চিতে ৪ মাইল বর্ণনাটিকে চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করার সময় প্রথমে ৩ ইঞ্চি একটি রেখা নিয়ে একে তিন ভাগ করতে হবে। বাম দিকের একটি ঘর ছেড়ে দিয়ে যথাক্রমে ০.৪, ৮ মাইল লিখতে হবে। বাম পাশের ঘরটিকে আবার ৪ ভাগে (কারণ ১ ইঞ্চিতে ৪ মাইল) ভাগ করতে হবে। শূন্য থেকে বাম দিকে যথাক্রমে ১.২.৩.৪ মাইল লিখতে হবে।
(গ) প্রতিভূ অনুপাতের সাহায্যে (By representative fraction) : বিভিন্ন দেশের সূরত্ব পরিমাণের জন্য স্বতন্ত্র একক ব্যবহার করা হয়। এরূপ এক দেশের এককের মাধ্যমে মানচিত্রে কেন প্রকাশ হলে ভাষাগত কারণে তা অন্য দেশের লোকের কাছে ব্যবহার যোগ্য হবে না। এ অসুবিধা নূর করার জন্য প্রতিভূ অনুপাত পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। ইংরেজিতে একে Representative Fraction বা সংক্ষেপে R.F. এবং বাংলার সংক্ষেপে প্র.অ. বলে। ভগ্নাংশের আকারে দেওয়া ফেলটির লব রাশি মানচিত্রের দূরত্ব এবং হর রাশি একই এককে ভূমির দূরত্ব প্রকাশ করে।
উদাহরণস্বরূপ ১ সেন্টিমিটারে ১ মিটার বর্ণনায় প্রকাশিত স্কেলটিকে প্রতিভূ অনুপাতে প্রকাশ করতে হলে মিটারটিকে সেন্টিমিটারে আনতে হবে এবং উভয় সংখ্যার মধ্যে অনুপাত চিহ্ন (:) দিতে হবে। ১ মিটার সমান ১০০ সেন্টিমিটার। সুতরাং লব রাশি ১ এবং হর রাশি ১০০। এক্ষেত্রে ক্ষেপটি ১:১০০ বা ১/১০০।
অর্থাৎ এর অর্থ মানচিত্রের সূরত্ব যখন ১ সেন্টিমিটার তখন ভূমির দূরত্ব ১০০ সেন্টিমিটার।
আবার ব্রিটিশ পদ্ধতিতে ১:৩৬ প্র.অ. দেওয়া থাকলে বুঝতে হবে মানচিত্রের দূরত্ব যখন ১ ইঞ্চি তখন ভূমির দূরত্ব ৩৬ ইঞ্চি বা ১ গজ। অতএব বর্ণনায় ১ ইঞ্চিতে ১ গজ। বর্ণনায় যখন ১ ইঞ্চিতে ১ মাইল, তখন প্র.অ. ১:৬৩৩৬০ যেহেতু ১ মাইল = ৬৮৩৩৬০ ইঞ্চি।
একটি বৃহদাকার দেশ ও মহাদেশকে আমরা একটি ছোট বই বা খাতার পৃষ্ঠায় অঙ্কন করে দেখাতে পারি। এছাড়া মানচিত্রটির সঙ্গে ভূমির প্রকৃত দূরত্বটি বোঝানোর জন্য স্কেল ব্যবহার করে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারি। মানচিত্র বললেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে একটি দেশ, একটি অঞ্চল তথা একটি ভূখণ্ডের চিত্র বা একটি মহাদেশ বা সমগ্র পৃথিবী। একটি মানচিত্রের মধ্যে কতকগুলো সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে মহাদেশটিতে কতটি দেশ এবং একেকটি দেশের মধ্যে কতটি প্রদেশ, বিভাগ, জেলা, রাস্তা, মन-मनী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি দেখাতে পারি। এভাবে একটি দেশ ও মহাদেশের মধ্যে আমরা চাইলে ছোট একটি স্থানকেও সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতে পারি। সর্বোপরি বলা যায়, কোনো স্থানের অবস্থান থেকে শুরু করে ঐ স্থানের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য মানচিত্রের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং, বলা যায় খুব কম সময়ে সহজ উপায়ে ঘরে বসে সারা বিশ্বকে জানার জন্যই মানচিত্রের উৎপত্তি। একটি মানচিত্রের মধ্যে কী ধরনের তথ্য থাকবে তা নির্ভর করবে- (ক) ভেল, (4) অতিক্ষেপ, (গ) কনভেনশনাল সাইন, (খ) মানচিত্র অঙ্কনকারীর দক্ষতা এবং (8) মানচিত্র অঙ্কনের ধরনের উপর। একটি বৃহৎ ভেলের মানচিত্রের মধ্যে একটি স্থানকে বেশি তথ্য দিয়ে দেখানো যায়।
মানচিত্র অঙ্কন করার জন্য তোমার কিছু বিষয় জানতে হয়। মানচিত্র বিভিন্ন রকমের হয়। প্রতি মানচিত্রেই বিভিন্ন বিষয় থাকে। এগুলো বিভিন্ন রং, রেখা ও সংকেত দিয়ে বোঝানো হয়। এই রং, রেখা ও সংকেত হলো মানচিত্রের ভাষা। মানচিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এসব ভাষা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক সভ্যতায় মানচিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ইতিহাসবিদ, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক,
সৈনিক ও নাবিকদের নিকট মানচিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভূগোলবিদ ও ভূগোলের শিক্ষার্থীদের নিকট মানচিত্র একটি অপরিহার্য উপাদান।
মানচিত্র অনেক প্রকার হতে পারে। সাধারণত মানচিত্রে ব্যবহৃত স্কেল এবং বিষয়বস্তু অনুসারে মানচিত্রগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। স্কেল অনুসারে মানচিত্র আবার দুই প্রকারের-
(ক) বৃহৎ স্কেলের মানচিত্র এবং
(খ) ক্ষুদ্র ভেলের মানচিত্র।
নৌচলাচল সংক্রান্ত নাবিকদের চার্ট, বিমানচলাচল সংক্রান্ত বৈমানিকদের চার্ট, মৌজা মানচিত্র বা ক্যাডাস্ট্রাল মানচিত্র প্রভৃতি বৃহৎ স্কেলের মানচিত্র। একটি ছোট এলাকা অনেক বড় করে দেখানো হয় বলে মানচিত্রের মধ্যে অনেক জায়গা থাকে এবং অনেক কিছু তথ্য এরূপ মানচিত্রে ভালোভাবে দেখানো যায়। ভূচিত্রাবলি মানচিত্র, দেয়াল মানচিত্র প্রভৃতি ক্ষুদ্র স্কেলের মানচিত্র। সমগ্র পৃথিবী বা মহাদেশ বা দেশের মতো বড় অঞ্চলকে একটি ছোট কাগজে দেখানো হয় বলে এ প্রকার মানচিত্রে বেশি জায়গা থাকে না। ফলে এ মানচিত্রে বেশি কিছু দেখানো যায় না।
উপস্থাপিত বিষয়বস্তু হিসেবেও মানচিত্রগুলো দুই প্রকারের- (ক) গুণগত মানচিত্র এবং (খ) পরিমাণগত মানচিত্র।
(ক) গুণগত মানচিত্র ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র, ভূসংস্থানিক মানচিত্র, ভূমিরূপের মানচিত্র, মৃত্তিকা মানচিত্র, দেয়াল মানচিত্র, ভূচিত্রাবলি মানচিত্র, স্থানীয় বৈচিত্র্যসূচক মানচিত্র এবং মৌজা মানচিত্র গুণগত মানচিত্রের অন্তর্গত।
(খ) পরিমাণগত মানচিত্র বায়ুর উত্তাপ, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, জনসংখ্যার বণ্টন, জনসংখ্যার ঘনত্ব, খনিজ উৎপাদন, বনজ উৎপাদন, শিল্পজ উৎপাদন প্রভৃতি পরিসংখ্যান তথ্য যেসব মানচিত্রে দেখানো হয় সেসব মানচিত্র পরিমাণগত মানচিত্রের অন্তর্গত। কার্যের উপর ভিত্তি করে কয়েক প্রকার মানচিত্র নিম্নরূপ :
১। ক্যাডাস্ট্রাল বা মৌজা মানচিত্র (Cadastral or Mouza map)ঃ ক্যাডাস্ট্রাল শব্দটি এসেছে ফ্রেঞ্চ শব্দ ক্যাডাস্ট্রে (Cadastre) থেকে, যার অর্থ হচ্ছে রেজিস্ট্রিকৃত নিজের সম্পত্তি। এই মানচিত্র তৈরি করা হয় সাধারণত কোনো রেজিস্ট্রিকৃত ভূমি অথবা বিল্ডিং-এর মালিকানার সীমানা চিহ্নিত করার জন্য। আমাদের দেশে আমরা যে মৌজা মানচিত্রগুলো দেখতে পাই সেগুলো আসলে ক্যাডাস্ট্রাল মানচিত্র। এই মানচিত্রের মাধ্যমেই হিসাব করে সরকার ভূমির মালিক থেকে কর নিয়ে থাকে। এই মানচিত্র সবচেয়ে বড় ।
এই মানচিত্রে নিখুঁতভাবে সীমানা দেওয়া থাকে। এই মানচিত্রগুলো বৃহৎ স্কেলে অঙ্কন করা হয়, যা ১৬ ইঞ্চিতে ১ মাইল বা ৩২ ইঞ্চিতে ১ মাইল। এই ধরনের মানচিত্রের মধ্যে বিবিধ তথ্য প্রকাশ করা হয়। শহরের পরিকল্পনার মানচিত্রও এই মৌজা মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত ।
২। সানিক মানচিত্র (Topographic map)ঃ সংস্থানিক- এর আরেক নাম হচ্ছে স্থানীয় বৈচিত্র্যাসূচক মানচিত্র। এই মানচিত্রগুলো প্রকৃত জরিপকার্যের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। সাধারণত এর মধ্যে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক দুই ধরনের উপাদান দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের মানচিত্রের খেল একেবারে ছোট না হলেও মেজা মানচিত্রের মতো বৃহৎও নয়। এই মানচিত্রগুলোতে কিন্তু জমির সীমানা দেখানো হয় না। ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে পাহাড়, মালভূমি, সমভূমি, নদী উপতাকা, হ্রদ প্রভৃতি দেখানো হয়। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হিসেবে রেলপথ, হাটবাজার, পোস্ট অফিস, সরকারি অফিস, খেলার মাঠ, মসজিদ, মন্দির প্রভৃতি নিখুঁতভাবে লেখানো হয় । বর্তমান যুগে বিমান থেকে ছবি তোলার মাধ্যমে এই মানচিত্রের নবযুগের সূচনা হয়। এই মানচিত্রের স্কেল ১:২০,০০০ হলে ভালোভাবে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায়।
বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন স্কেলে এই মানচিত্র তৈরি করে। সবচেয়ে আদর্শ ও জনপ্রিয় হচ্ছে ব্রিটিশদের তৈরি করা মানচিত্র যার ফেল ছিল ১:২৫,০০০ থেকে ১:১০০,০০০ এবং আমেরিকাতে এই মানচিত্রের স্কেল থাকে সাধারণত ১:৬২,৫০০ এবং ১:১২৫,০০০। বাংলাদেশ সাধারণত ব্রিটিশ স্কেলটি অনুসরণ করে।
৩। দেৱান মানচিত্র (Wall map)ঃ লেয়াল মানচিত্র তৈরি করা হয় সাধারণত শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করার জন্য। সারা বিশ্বকে অথবা কোনো গোলার্ধকে এই মানচিত্রের মধ্যে প্রকাশ করা হয়। দেয়াল মানচিত্রে আমাদের চাহিদা মতো একটি দেশ অথবা একেকটি মহাদেশকে আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয় বড় অথবা ছোট ফেলে (চিত্র ৩.৫)। এই দেয়াল মানচিত্রের স্কেল ভূসংস্থানিক মানচিত্রের চেয়ে ছোট কিন্তু ভূচিত্ৰাৰণি মানচিত্রের চেয়ে বড়।
৪। ভূচিত্রাবলি বা এটলাস মানচিত্র (Chorographical or Atlas map)ঃ মানচিত্রের সমষ্টিকে ভূচিত্রাবলি (এটলাস) বলে। এই মানচিত্রকে সাধারণত খুব ছোট ফেলে করা হয়। এটি প্রাকৃতিক বাত এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে তৈরি করা হয়। বেশিরভাগ ভূচিত্রাবলি মানচিত্রে স্থানের অভাবে রং দিয়ে বৈশিষ্ট্য বোঝানো হয়। শুধু পাহাড়ের চূড়া, পুরত্বেপূর্ণ নদী এবং রেলওয়ের প্রধান রাস্তা বোঝানোর জন্য প্রতীক দেওয়া থাকে। কিছু কিছু চিত্রাবনি করা হয় ১:১০০০,০০০ স্কেলে। আমাদের দেশে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই মানচিত্র তৈরি করে থাকে। এই মানচিত্রে সমগ্র পৃথিবীকে একটি পৃষ্ঠার মধ্যে দেখিয়ে থাকে। বাংলাদেশকেও ঐ একটি পৃষ্ঠার মধ্যে জেলাগুলো ইত্যাদি দেখিয়ে থাকে। এতে প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও কৃষিভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানচিত্র তৈরি করা হয়।
৫। প্রাকৃতিক মানচিত্র (Physical map): যে মানচিত্রে কোনো দেশ বা অঞ্চলের বিভিন্ন প্রাকৃতিক ভূমিরূপ যেমন- পর্বত, মালভূমি, ভূমি, নদী, হ্রদ ইত্যানি সম্পর্কে তথ্য থাকে তাকে প্রাকৃতিক মানচিত্র বলে।
৬। ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র (Geological map): গঠনকারী বিলাসমূহের অবস্থান ও গঠনের উপর তিনি করে এই ধরনের মানচিত্র তৈরি করা হয়।
৭। জলবায়ুপত মানচিত্র (Climatic map): বাহুর তাপ, বায়ুর চাপ, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে জলবায়ুগত মানচিত্র বলে।
৮। উদ্ভিজ বিষয়ক মানচিত্র (Vegetation map) : বিশ্বের কোথায় কোন ধরনের প্রাকৃতিক উদ্ভিদ আছে তার উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে উদ্ভিদ বিষয়ক মানচিত্র বলে।
৯। মৃত্তিকা বিষয়ক মানচিত্র (Boll map): বিশ্বের কোথায় কোন ধরনের মাটি তার উপর ভিত্তি করে এই মানচিত্র তৈরি করা হয়। সাধারণত মাটির গুণাগুণের উপর ভিত্তি করেই বিশ্বের কোথায় কোন ধরনের ফসলের চাষ করা যাবে সেজন্য কৃষিবিদরা এই ধরনের মানচিত্র বেশি ব্যবহার করে থাকেন।
১০। সাংস্কৃতিক মানচিত্র ( Cultural map): বিভিন্ন স্থানের অর্থনৈতিক অবস্থ্য, বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের সীমা, ঐতিহাসিক কোনো স্থান বা স্থাপত্য, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে যে মানচিত্র তৈরি হয় তাকে সাংস্কৃতিক মানচিত্র বলে।
আবার সাংস্কৃতিক মানচিত্রকেও কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-
(ক) রাজনৈতিক মানচিত্র (Political map): বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের সীমা দেখিয়ে এই মানচিত্র তৈরি করা হয়। এর মধ্যে কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের রাজধানী ও গুরুত্বপূর্ণ শহরও দেখানো হয়।
(খ) বণ্টন মানচিত্র (Distribution map): যেসব মানচিত্রে জনসংখ্যা, শসা, জীবজন্তু, শিল্প ইত্যাদির বণ্টন কোনো একটি অঞ্চল বা দেশে দেখানো হয় তাকে বণ্টন মানচিত্র বলে।
(গ) ঐতিহাসিক মানচিত্র (Historical map): ঐতিহাসিক কোনো স্থান বা স্থাপত্যকে নিয়ে যেসব মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে ঐতিহাসিক মানচিত্র বলে।
(ঘ) সামাজিক মানচিত্র (Social map) : পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে মানচিত্রগুলো তৈরি করা হয়। বিশেষ করে যারা সামাজিক প্রথা ও বৈষম্য, জনসংখ্যা এসব নিয়ে গবেষণা করেন তারা এ মানচিত্র ব্যবহার করেন।
(ঙ) ভূমি ব্যবহার মানচিত্র (Land use map): কোন ভূমি কী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বা কোন ভূমি কোন কাজে ব্যবহার করলে সবচেয়ে বেশি উপযোগী তার উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে ভূমি ব্যবহার মানচিত্র বলে।
স্থানীয় বৈচিত্র্যসূচক মানচিত্র গঠন ভূগোল শাস্ত্রের একটি প্রধান ও প্রয়োজনীয় বিষয়। এই বিশাল পৃথিবীকে অথবা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের এক একটি সামাজিক রূপ এই ধরনের মানচিত্রের মধ্যে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় অন্য কোনো উপায়েই তা সম্ভব নয়। স্থানীয় বৈচিত্র্যসূচক মানচিত্রে বিভিন্ন প্রতীক চিহ্নের মাধ্যমে ভূপ্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়সমূহের একটি সুন্দর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রতীকগুলোর মাধ্যমে একদিকে যেমন পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, মালভূমি, হ্রদ, সমভূমি, পুকুর, ঝিল, বনভূমি প্রভৃতি বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায় তেমনি অন্যদিকে রাস্তাঘাট, হাটবাজার, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল, খেলার মাঠ, জনবসতি, মানুষের ঘনত্ব, জীবিকা অর্জনের উপায় প্রভৃতি নানা সাংস্কৃতিক তথ্যেরও পরিচয় পাওয়া যায়। এই কারণে কোনো একটি অঞ্চলের সুবিধা-অসুবিধা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং নানা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে চাইলে এই মানচিত্রে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের নিয়মাবলি জানা একান্ত প্রয়োজন। যে কোনো ভাষায় একটি মানচিত্র পাঠ করতে হলে নানা ধরনের প্রতীক চিহ্নের সাহায্য নিতে হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের স্থানীয় বৈচিত্র্যসূচক মানচিত্রের মধ্যে এ সকল প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করে আসছে। এই কারণে এসব চিহ্নকে আন্তর্জাতিক প্রচলিত প্রতীক চিহ্ন বলে (চিত্র ৩.৬)। স্থানীয় বৈচিত্র্যসূচক মানচিত্র পাঠ করার জন্য এই প্রতীক চিহ্নগুলো অত্যন্ত জরুরি বলে মানচিত্রের নিচের দিকে বাই প্রতীক চিহ্নগুলোর সূচক (Legend) দেওয়া থাকে। যে ব্যক্তির এই চিহ্নগুলো সম্বন্ধে যত ভালো ধারণা থাকবে তিনি তত ভালোভাবে এই মানচিত্র পাঠ করতে পারবেন।
একটি মানচিত্রে তথ্য উপস্থাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় হলো :
আমাদের পৃথিবীকে ৩৬০° দ্রাঘিমারেখা দিয়ে ভাগ করা হয়েছে। এই ৩৬০° কে আবার মূল মধ্যরেখা থেকে দুই দিকে অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ১৮০° করে ভাগ করা হয়েছে। এই ৩৬০° দ্রাঘিমা পুরোটাই আসলে কাল্পনিক। আমরা জানি পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার পুরোটি ঘুরে আসছে। হিসাব করলে দেখা যাবে ৩৬০° ঘুরে আসতে সময় লাগছে ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ ২৪ X ৬০ - ১৪৪০ মিনিট। এই ১৪৪০ মিনিটকে ৩৬০° দিয়ে ভাগ করলে (১৪৪০ + ৩৬০) ৪ মিনিট। অর্থাৎ প্রতি ডিগ্রি দ্রাঘিমার পার্থক্যের জন্য সময় লাগছে ৪ মিনিট।
স্থানীয় সময় (Local Time)
পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। পৃথিবীর যে অংশটি পূর্ব দিকে সেই অংশটিতে আগে সূর্যোদয় বা সকাল হয়। পৃথিবীর আবর্তনের ফলে কোনো একটি স্থানে সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর আসে তখন ঐ স্থানে মধ্যাহ্ন। ঐ ছাদের
ঘড়িতে তখন দুপুর ১২টা ধরা হয়। এই মধ্যাহ্ন থেকেই দিনের অন্যান্য সময়গুলো ঠিক করা হয়। আকাশে সূর্যের অবস্থান থেকে যে সময় স্থির করা হয় তাকে স্থানীয় সময় বলে। ঐ স্থান থেকে যত দূরের স্থান হবে সে হিসেবে প্রতি ১° দ্রাঘিমার জন্য সময় বাড়বে বা কমবে। স্থানটি যদি সেই স্থানের পশ্চিমের দিকের স্থান হয় তবে এর ১° ব্যবধানের জন্য ৪ মিনিট কম হবে। স্থানটি পূর্ব দিকের হলে ১০ ব্যবধানের জন্য ৪ মিনিট বেশি হবে। অর্থাৎ পূর্ব দিকের স্থানের সময় নির্ণয়ের জন্য ঐ স্থানের সময়ের সঙ্গে প্রতি ডিগ্রি ব্যবধানের জন্য ৪ মিনিট যোগ করতে হবে। কারণ সেই স্থানটি যেহেতু পূর্বে অবস্থিত তাই সেখানে আগেই মধ্যাহ্ন হয়েছে অর্থাৎ ১২টা বেজেছে।
প্রমাণ সময় (Standard Time)
দ্রাঘিমারেখার উপর সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে আমরা সময় ঠিক করি। এভাবে মধ্যাহ্ন সূর্যের অবস্থানকে সেই স্থানের দুপুর ১২টা ধরে স্থানীয় সময় নির্ধারণ করলে সাধারণত একটি বড় দেশের মধ্যে সময়ের গণনার বিভ্রাট হয়। এই সময়ের বিভ্রাট থেকে বাঁচার জন্য প্রত্যেক দেশে একটি প্রমাণ সময় নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত কোনো একটি দেশের মধ্যভাগের দ্রাঘিমারেখা অনুযায়ী যে সময় নির্ধারণ করা হয় সে সময়কে ঐ দেশের প্রমাণ সময় ধরা হয়।
দেশের আয়তনের উপর ভিত্তি করে প্রমাণ সময় একাধিক হতে পারে। আমরা জানি যুক্তরাষ্ট্রে ৪টি এবং কানাডাতে ৬টি প্রমাণ সময় রয়েছে। সেসব দেশগুলোর প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজের সুবিধার জন্য তারা একাধিক প্রমাণ সময় ব্যবহার করছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরের অদূরে অবস্থিত গ্রিনিচের (০° দ্রাঘিমায়) স্থানীয় সময়কে সমগ্র পৃথিবীর প্রমাণ সময় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের পূর্ব দিকে অবস্থিত তাই আমাদের দেশে প্রমাণ সময় গ্রিনিচের সময়ের অগ্রবর্তী অর্থাৎ আমাদের এখানে গ্রিনিচের মধ্যাহ্নের পূর্বেই মধ্যাহ্ন হয়ে থাকে। গ্রিনিচের দ্রাঘিমা ০° অন্যদিকে আমাদের বাংলাদেশের ঠিক মাঝখান দিয়ে ৯০° পূর্ব দ্রাঘিমারেখা অতিক্রম করেছে। আর আমরা জানি প্রতি ১ ডিগ্রির জন্য সময়ের পার্থক্য হয় ৪ মিনিট। তাই ৯০°-এর জন্য সময়ের পার্থক্য হবে ১০ X ৪ - ৩৬০ মিনিট বা ৬ ঘণ্টা। ৯০° পূর্ব প্রাঘিমার স্থানীয় সময়কে বাংলাদেশের প্রমাণ সময় ধরে কাজ করা হয়। আমাদের এখানে যখন দুপুর ১২টা তখন যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে সকাল ৬টা বাজে।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখেছি প্রতি ডিগ্রি দ্রাঘিমার জন্য সময়ের পার্থক্য হচ্ছে ৪ মিনিট। আমরা জানি যে পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। এজন্যই পূর্ব দিকের স্থানগুলোতে আগে দিন হচ্ছে এবং পশ্চিম নিকের স্থানগুলোতে পরে নিন হচ্ছে। এতে আমরা বুঝতে পারি আমাদের বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশ পূর্ব দিকে অবস্থিত সেসব দেশে আগে সকাল হবে এবং আমাদের পশ্চিম দিকের দেশগুলোতে পরে সকাল হবে।
আমরা জানি, প্রতি ডিগ্রি দূরত্বের জন্য সময়ের ব্যবধান হচ্ছে ৪ মিনিট। এই প্রতিটি ডিগ্রিকে ৬০ মিনিটে ভাগ করা হয় এবং প্রতি ১ মিনিট দূরত্বের জন্য ৪ সেকেন্ড সময়ের পার্থক্য হয়। এখানে একটি বিষয় লক্ষ করতে হবে দূরত্বের ব্যবধানের মিনিটকে অনেকে সময়ের মিনিট হিসেবে ধরে ভুল করে। আসলে দূরত্বের মিনিট হচ্ছে প্রতি ১ ডিগ্রিকে ৬০ মিনিটে ভাগ করা হয়। এই দূরত্বের ৬০ মিনিটের প্রতি মিনিটের জন্য সময়ের ৪ সেকেন্ড লাগে। এভাবে দূরত্বের ব্যবধানের ৬০ মিনিটের জন্য লাগে ৬০x৪ = ২৪০ সেকেন্ড অর্থাৎ ৪ মিনিট সময় ।
স্থানভেদে সময়ের পার্থক্য ভালোভাবে বুঝতে হলে কিছু গাণিতিক সমাধান করতে হবে।
উদাহরণ ১ঃ ঢাকা থেকে পূর্বে অবস্থিত একটি স্থানের দ্রাঘিমার পার্থক্য ৫০৩০'। ঢাকায় যখন ভোর ৬টা তখন সেই স্থানের স্থানীয় সময় কত?
সমাধানঃ
ঢাকা থেকে স্থানটির ব্যবধান ৫০৩০'
(৫০x৪) মিনিট + (৩০x৪) সেকেন্ড (পূর্ব দ্রাঘিমায় এই ব্যবধানের জন্য সময়ের পার্থক্য যোগ হবে)
- ২০০ মিনিট + ১২০ সেকেন্ড
- ২০০ মিনিট + ২ মিনিট। যেহেতু ১ মিনিট - ৬০ সেকেন্ড
- ২০২ মিনিট
সময়ের ব্যবধান হবে ২০২ মিনিট বা ৩ ঘণ্টা ২২ মিনিট
এখানে যে স্থানটির স্থানীয় সময় নির্ণয় করতে হবে সেটা ঢাকার পূর্ব দিকে অবস্থিত। সুতরাং স্থানীয় সময় ঢাকার সময়ের চেয়ে বেশি হবে কারণ পূর্ব দিকে সূর্য আগে উদিত হয়েছে। তাই ঢাকার সময়ের সঙ্গে ৩ ঘণ্টা ২২ মিনিট যোগ করতে হবে।
স্থানটির সময়
ঢাকার সময় সময়ের পার্থক্য
- ৬টা + ৩ ঘণ্টা ২২ মিনিট
- ৯টা ২২ মিনিট
সকাল ৯টা ২২ মিনিট
৩. স্থানটির নির্ণেয় স্থানীয় সময় ১টা ২২ মিনিট।
উত্তর : সকাল ১টা ২২ মিনিট।
উদাহরণ ২। ঢাকার দ্রাঘিমা ৯০° পূর্ব এবং রিয়ালের দ্রাঘিমা ৪৫° পূর্ব। ঢাকার স্থানীয় সময় দুপুর ২টা হলে সেই সময় রিয়াদের স্থানীয় সময় কত?
সমাধানঃ
আমরা জানি, প্রতি ডিগ্রি দ্রাঘিমার জন্য সময়ের পার্থক্য ৪ মিনিট
ঢাকা ও রিয়াদের দ্রাঘিমার পার্থক্য ১০°- ৪৫° = 850
সময়ের পার্থক্য হবে ৪৫ X ৪ ১৮০ মিনিট অর্থাৎ ৩ ঘণ্টা প্রশ্নে উল্লিখিত ৪৫° পূর্ব দ্রাঘিমা দেখে আমরা বুঝতে পারি, রিয়াদ ঢাকার পশ্চিমে অবস্থিত। তাই ঢাকার স্থানীয়
সময় থেকে এই ৩ ঘণ্টা বাদ যাবে।
রিয়াদের স্থানীয় সময় হবে
-দুপুর ২টা-৩ ঘণ্টা। এখানে দুপুর ২টা বলতে ১৪টা হবে।।
- ১৪টা – ৩ ঘণ্টা
- ১১ টা
উত্তর : রিয়াদের স্থানীয় সময় হবে সকাল ১১টা।
উদাহরণ ৩। 'ক' শহরের দ্রাঘিমা ৭০°৪৫′ পূর্ব এবং 'খ' শহরের দ্রাঘিমা ১৫°১৫′ পূর্ব। 'ক' শহরের স্থানীয় সময় সকাল ৭টা হলে 'ব' শহরের স্থানীয় সময় কত?
সমাধানঃ
দুটি শহরের দ্রাঘিমার পার্থক্য - ৭০°৪৫ - ১৫°১৫′ - 60°00'
আমরা জানি, প্রতি ১°-এর জন্য সময়ের পার্থক্য ৪ মিনিট এবং প্রতি ১০-এর জন্য সময়ের পার্থক্য ৪ সেকেন্ড
সুতরাং, ৫৫"৩০'-এর জন্য সময়ের পার্থক্য হবে
= (৫৫ × ৪) মিনিট + (৩০ x ৪) সেকেন্ড
- ২২০ মিনিট + ১২০ সেকেন্ড
- ২২০ মিনিট + ২ মিনিট। যেহেতু ১ মিনিট ৬০ সেকেন্ড
- ২২২ মিনিট - ৩ ঘণ্টা ৪২ মিনিট
যেহেতু 'ক' শহরের দ্রাঘিমা থেকে 'হু' শহরের দ্রাঘিমার মান কম সেহেতু আমরা বুঝতে পারি 'খ' শহরটি 'ক'
শহরের পশ্চিমে অবস্থিত। তাই 'ক' শহরের স্থানীয় সময় থেকে সময়ের ব্যবধান বিয়োগ করলে 'খ' শহরের স্থানীয় সময় পাওয়া যাবে। সুতরাং, সময় হবে-
"খ" স্থানের স্থানীয় সময়
= সকাল ৭টা - ৩ ঘণ্টা ৪২ মিনিট
- ৩টা ১৮ মিনিট অর্থাৎ ভোর ৩টা ১৮ মিনিট
উত্তর: "খ" শহরের স্থানীয় সময় ভোর ৩টা ১৮ মিনিট।
উদাহরণ ৪। ঢাকা ও টোকিওর স্থানীয় সময়ের ব্যবধান ৩ ঘণ্টা ১৭ মিনিট ১৬ সেকেন্ড। ঢাকার দ্রাঘিমা ৯০°২৬' পূর্ব হলে টোকিওর দ্রাঘিমা কত?
সমাধানঃ
ঢাকা ও টোকিওর সময়ের ব্যবধান ৩ ঘন্টা ১৭ মিনিট ১৬ সেকেন্ড
- (১৮০+১৭) মিনিট ১৬ সেকেন্ড ১৯৭ মিনিট ১৬ সেকেন্ড
প্রতি ৪ মিনিটে ১° এবং প্রতি ৪ সেকেন্ডে ১ মিনিট সময়ের পার্থক্য হিসাব করে পাওয়া যায়,
১৯৬ মিনিট-এর জন্য ৪৯ এবং বাকি ১ মিনিট ১৬ সেকেন্ড-এর জন্য ১১' অর্থাৎ ৪৯°১১। সুতরাং টোকিও ঢাকার পূর্বে বলে এর দ্রাঘিমা হবে ১০°২৬ + ৪৯°১১- ১৩৯°৪৫′ পূর্ব।
উত্তর : ১৩৯°৪৫′ পূর্ব।
বর্তমানে মানচিত্র তৈরী, পঠন এবং ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে আধুনিক ব্যবহার হচ্ছে জিপিএস এবং জিআইএস। জিপিএস-এর ইংরেজি হলো Global Positioning System (GPS)। কোনো একটি স্থানের ভৌগোলিক অবস্থান জানতে চাইলে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে জিপিএস-এর মাধ্যমে জানা।
জিপিএস দ্বারা যেসব কাজ করা যায় তা হলোঃ
জিপিএস দ্বারা কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানের অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, উচ্চতা ও দূরত্ব জানা যায়। এছাড়া ঐ স্থানের উত্তর দিক, তারিখ ও সময় জানা যায়।
জিপিএস-এর কার্যনীতি (Working Principle of GPS): জিপিএস তার রিসিভার দিয়ে ভূ-উপগ্রহ থেকে তথ্য সপ্তাহ করে । এই তথ্য সপ্তাহের জন্য জিপিএস-এর মোটামুটি মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশের প্রয়োজন হয়। তখন জিপিএস যন্ত্রটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। কোনো কোনো সময় উঁচু খাড়া পাহাড়,উঁচু ইমারত থাকলে তখন জিপিএস দ্বারা সেই স্থানের অবস্থান নির্ণয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং এতে সময় বেশি লাগে। জিপিএস-এর সুবিধা প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কারের মধ্যে ভূগোলবিদদের জন্য জিপিএ একটি অত্যন্ত মূল্যবান যন্ত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ যন্ত্রের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে আমরা কোনো একটি স্থানের অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ থেকে শুরু করে সব বিষয়ে জানতে পারছি। বিশেষ করে আমাদের দেশে ভূমির জরিপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয়। এখন আমরা জিপিএস-এর মাধ্যমে ঝামেলা ছাড়াই জমির সীমানা চিহ্নিত করতে পারব।
এতে করে সময় অনেক কম অপচয় হবে। যে কোনো দুর্যোগকালীন সময়ে আমরা এই জিপিএস-এর মাধ্যমে কোনো একটি স্থানের অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ জানতে পেরে তার সঠিক অবস্থান জেনে সেখানে সাহায্য পাঠাতে পারব। জিপিএস-এর অসুবিধা: জিপিএস-এর সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধাও রয়েছে। তা হলো- এর মূল্য বেশি তাই সহজলভ্য নয়, বেশিরভাগ জনগণ এর সঙ্গে পরিচিত নয়, বেশিরভাগ লোক এটি চালাতে পারে না। এছাড়া রয়েছে সনাতনী পদ্ধতি না ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা।
জিআইএস (Geographical Information System)
ভৌগোলিক তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ ব্যবস্থাকে সংক্ষেপে জিআইএস বলে। এটি কম্পিউটারের মাধ্যমে তথ্য সম্ভরক্ষণ ও বিশ্লেষণ ব্যবস্থা যার মধ্য দিয়ে ভৌগোলিক তথ্যগুলোর সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্থানিক ও পারিসরিক সমস্যা চিহ্নিতকরণ, মানচিত্রায়ণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরিতে সহায়তা করে থাকে। এই জিআইএস-এর ব্যবহার শুরু হয়েছে বেশি দিন হয়নি। ১৯৬৪ সালে কানাডায় সর্বপ্রথম এই কৌশলের ব্যবহার আরম্ভ হয়। ১৯৮০ সালের দিক থেকে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
বর্তমানে ভূমি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন, পানি গবেষণা, আঞ্চলিক গবেষণা, নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা, জনসংখ্যা বিশ্লেষণ, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশ্লেষণ প্রভৃতি বহুবিধ কাজে জিআইএস ব্যবহার হচ্ছে।
জিআইএস-এর মাধ্যমে একটি মানচিত্রের মধ্যে অনেক ধরনের উপাত্ত উপস্থাপন ঘটিয়ে সেই উপাত্তগুলোকে মানচিত্রের মধ্যে বিশ্লেষণ করে মানচিত্রটির উপযোগিতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। যেমন- একটা মানচিত্রের মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনা, টপোগ্রাফি, ভূমি ব্যবহার, যোগাযোগ, মৃত্তিকা ও রাস্তা এই সবগুলো জিনিস দেখিয়ে আমরা তার মধ্য দিয়ে সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের পুরো চিত্র সম্বন্ধে জানতে পারি।